ভালবাসার গল্প: দাগ

তার নাম ছিল কেয়া। আমার দেখা এখন পর্যন্ত সবচাইতে সুন্দর একটি মুখ। আমরা ছিলাম প্রতিবেশি। এখন যেমন এই ফ্ল্যাটের মানুষ তার পাশের ফ্ল্যাটের খোজ জানেনা। প্রতিবেশি বলতে এখন যা বুঝায় ১৫-২০ বছর আগেও প্রতিবেশির অর্থ ঢাকা শহরে এমনটা ছিলনা। পুরো এলাকার খোজ সবাই রাখত। সবাই সবাইকে চিনত।

কোন রকম স্কুলের পড়াটা শেষ করেই আমরা একদল ছেলে মেয়ে খেলতে বেড়িয়ে পরতাম। কত ধরনের খেলা যে তখন ছিল! বরফ-পানি, ছোয়া-ছুই, মাংস চোর, কুমির কুমির, ফুল টোক্কা, লাফ দরি, লুকোচুরি। আরো কত কিছু যে ছিল! নামও মনে নেই এখন সবগুলোর। এখন যেমন কিছু খেলাকে মেয়েদের খেলা হিসেবে ধরা হয় তখন এমনটা ছিলনা। আমরা ছেলে মেয়ে মিলে সব খেলতাম। আমাদের দলটা ছিল বিশাল। এই দলের মধ্যে কেয়া ছিল আমার সবচাইতে ভাল বন্ধু। খেলাধুলা শেষ করে সন্ধ্যায় যখন হাতে পায়ে ধুলা বালি এবং কাটা-কাটি নিয়ে বাসায় ফিরতাম তখন দুজনের মা-ই দুজনকে আচ্ছা রকম বানাত। পড়া শেষ করেই কখনো ও আমাদের বাসায় চলে আসত অথবা আমি ওদের বাসায় চলে যেতাম। হিসেব করতে বসতাম কে কয়টা ফরিং ধরেছি অথবা ডুমুর গাছের পাতা পেচিয়ে যে টুনটুনিটা বাসা বেধেছে ওটার ডিম চুড়ি করলে কি পাপ হবে কিনা, বুড়ির বাড়ির বাগানের পেয়ারাগুলো খেতে কেমন হবে। আরো কত কিছু নিয়ে যে কথা হত আমাদের! পাঞ্জা লড়তাম দুজন মিলে, লুডু খেলতাম। মাঝে মাঝে মারা-মারিও হত। ও খামচি দিয়ে আমার হাত-পা ছিলে ফেলত আমি ওর চুল টেনে ধরতাম।

একদিন ও বলল যে দেখি তোর হতটা দে তো। আমি ভালমানুষের মত হাত বাড়িয়ে দিলাম। ও হাতের আঙ্গুলের নখের উপর খুব জোরে চাপ দিয়ে বলল, কিরে ব্যাথা পাচ্ছিস না? ব্যাথায় আমার জান শেষ হয়ে যাচ্ছিল। তবুও ভাব ধরে বললাম,
-কই নাতো। একদমই ব্যাথা পাচ্ছিনা।
তখন ও নখের উপর থেকে হাত সরিয়ে কড়ে আঙ্গুলের ঠিক গোরার দিকে নখ দিয়ে খুব জোরে চাপ দিল।
-বল এবার ব্যাথা পাচ্ছিস না?
-বললাম কই না তো! এখনো ব্যাথা পাচ্ছিনা। ও যখন হাত সরিয়ে নিল তখন ঐ চেপে ধরা অংশ থেকে কয়েক ফোটা রক্ত বের হয়ে আসল। ও তখন অবাক হয়ে আমার দিকে চেয়ে থেকে বলল,
-কিরে তুই ব্যাথা পাশ নাই? তোর হাত তো কেটে গেছে! হুম তো কি হইছে। কাটলেও আমি ব্যাথা পাইনা। ও তারপর স্যাভলন এনে লাগিয়ে দিয়েছিল।
সেই যে একটা দাগ পরল। এত বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরে এখনও ঐ জায়গায় দাগটা রয়ে গেছে। এই দাগটা যখন চোখে পরে তখন শৈশবের অনেকটা লাফ দিয়ে চোখের সামনে চলে আসে। আর আসে সেই সুন্দর মুখটা।
নিজেদের বাড়ি না হলে এই শহরে কেউই স্থায়ী হয় না। যাজাবরের মত ঘুরতে থাকে এই শহরের বাসিন্দারা। আমরা একসময় ঐ এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় চলে যাই। একটু বড় হওয়ার পর যখন বুঝতে শিখেছি, অনেক খোজার চেষ্টা করেছি ওদের। কোন ঠিকানা বের করতে পারিনি। ওরাও কোথায় চলে গেছে কেউ বলতে পারেনা। সেই ছোটবেলার কয়েকজন বন্ধুর কাছেও জানতে চেয়েছি কেয়াদের কথা। শুধু একজন বলতে পারল যে, ওরা নাকি মিরপুরের দিখে চলে গেছে। তারপর আর চেষ্টা করিনি। সেই অনিন্দ সুন্দর মুখটা আস্তে আস্তে ধুসর হয়ে যাচ্ছিল।

এক বার্ষার কথা। হঠাত আসা বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পেতে দৌড়ে এক শপিং মলের ভিতর আশ্রয় নেই। এলোমেলো ঘুরতে থাকি শপিং মলের এক ফ্লোর থেকে আরকে ফ্লোরে। একটা গিফট গ্যালারির সামনে এসে হঠাত আটকে গেলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম ভুল দেখছি। কিন্তু তা কি করে হয়! সেই চোখ, ঠোট বাকিয়ে সেই হাসি। এত বছর পরেও এতটুকু বদলায়নি।

হুম, সে-ই। আমার ভুল হচ্ছেনা। বুঝতে পারছিনা কি করব। যাকে একটা সময় কত খুজেছি! চেনা অচেনা সবার কাছে তার একটু খোজ পাওয়ার জন্য ছুটে গিয়েছি। আজ সে এত কাছে আথচ তার সামনে গিয়ে দাঁড়াবার সাহস হচ্ছেনা। নিজের ভেতর কে যেন বলতে থাকে। কিছু একটা কর। হারিয়ে যাওয়া মানুষটাকে সৃষ্টিকর্তা আবার তোমার সামনে নিয়ে এসেছে। হয়ত এটাই তোমার শেষ সুযোগ। আজ চুপ করে থাকলে হয়ত চিরতরে হারিয়ে ফেলবে।
যদি ভুলে গিয়ে থাকে? যাদি চিনতে না পারে? তাহলে তো সারাজীবন কষ্ট থেকে যাবে। আমি তোমার প্রত্যিটা স্মৃতি মনে রেখেছি কিন্তু তুমি আমাকে ভুলে গেলে! এটাওতো মেনে নিতে পারবোনা।

ঘুরে হাটা দিবো কিনা ভাবছি। যদি আজ চলেই যাই নিজের কাছে কি অপরাধী থেকে যাবোনা সারাজীবন? জীবনের প্রান্তলগ্নে এসে হয়তো মনেহবে, অনেক বড় ভুল করেছিলাম। নয়ত জীবনটা অন্যরকম হতে পারত।
কেয়ার সাথে অন্য একটি মেয়েও আছে। কে হতে পারে? হয়ত কাজিন অথবা ফ্রেন্ড। অনেক্ষণ ধরে ওরা একটা আর্ট পিস দেখছে। হয়তো কারো জন্মদিনে গিফট করবে। আমার সাথে এখনো চোখা-চোখি হয়নি। আমাকে দেখলে কি ও চিনতে পারেবে? দেখা যাক চিনতে পারে কিনা। যদি চোখের ভাব দেখে মনেহয় চেনা চেনা লাগছে তাহলে সামনে গিয়ে দাঁড়াবে, কথা বলবে। নয়ত না।


কে এই ছেলেটা? কখন থেকে দেখছি কেমন অবাক দৃষ্টিতে বারবার এদিকে তাকাচ্ছে। ছেলেটা বুঝতেও পারছেনা যে আমি তাকে লক্ষ্য করছি। খুব চেনা একটা মুখ। বার বার মনে হচ্ছে কোথায় যেন দেখেছি। কতদিনের চেনা!
– এই কেয়া, কি ভাবছিস কখন থেকে? চল এটাই নিয়ে নেই। এখনো আমার ড্রেস কেনা বাকি আছে।
শোভার ডাকে কেয়ার চিন্তায় ছেদ পরে।
– হুম, ঠিক আছে। এটাই নিয়ে নে।
দোকান থেকে বেরিয়ে হাটাতে থাকে ওরা। এই ফ্লোরে মেয়েদের পোশাক নেই। উপরের ফ্লোরে যেতে হবে। হাটতে থাকে ওরা। আড় চোখে কেয়া দেখতে পায়, ছেলেটাও অনেকটা দূরত্ব বজায় রেখে পিছন পিছন আসছে।
আজ শোভার বয়ফ্রেন্ডের জন্মদিন। তার জন্যেই গিফট কিনতে আসা। গিফটতো কেনা হল। এখন সে নিজের জন্য শাড়ি কিনবে নাকি থ্রি-পিস কিনবে মেয়েটা সেটাই ঠিক করতে পারছেনা। একবার শাড়ির দোকানে ঢুকছে। একবার থ্রিপিস দেখছে।
কেয়া আড় চোখে দেখছে। ওরা যেখানে যেখানে যাচ্ছে, ছেলেটাও যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে ওদের পিছনে পিছনে আসছে।
শোভা অবশেষে একটা শাড়ি কিনে ফেলল। শোভার শপিং করতে এলে কখনই দুই ঘন্টার কমে শেষ হয়না। ও যদি একটা জিনিসও কেনে তাহলেও আগে একঘন্টা শুধু ঘুরবে। এই যন্ত্রনায় কেয়া ওর সাথে শপিং-এ আসতে চায় না। আজ তারাতারই হয়ে গেল বলতে গেলে!
কেয়া খেয়াল করল ছেলেটা অনেকটা কাছে চলে এসেছে। সে মনেহয় কিছু বলতে চায়। এই সময় কেয়ার ফোন বেজে উঠলো। ফোন করেছে শোভার বয়ফ্রেন্ড। কেয়া অবাক হল। তারেক ওকে কেন ফোন করল!
– হ্যালো কেয়া, শোভা কি তোমার সাথে? ওর ফোন বন্ধ কেন?
– হুম আমার সাথেই তো। ফোন মনেহয় বন্ধ হয়ে গেছে। তখন থেকে বলছিল চার্জ প্রায় শেষের দিকে। আমরা তো তোমার জন্য গিফট কিনতে এসেছি।
– তাই নাকি! কি গিফট কিনলে?
– বলা যাবেনা। সারপ্রাইজ!
– ওকে, তোমরা তাহলে চলে এসো তারাতারি। রাখি তাহলে।
ফোন রেখে কেয়া দেখল শোভা আরো কি কি যেন দেখছে দোকানে।
আশ্চর্য! ছেলেটা কই গেল। আরতো দেখতে পাচ্ছিনা।


নাহ এখানে আর দাঁড়ানো ঠিক হবেনা। যা বুঝার বুঝা হয়ে গেছে। কেয়ার এখন কারো সাথে সম্পর্ক আছে। ফোনে কথা শুনে স্পষ্টই বুঝা গেল। বয়ফ্রন্ডের জন্য গিফট কিনল, সারপ্রাইজ দিবে বলে কি গিফট সেটা বলল না। এখন আমি গিয়ে পরিচয় দিতে গেলে উটকো ঝামেলা মনে করবে। তার থেকে চলে যাওয়াই ভাল।
যাক ভলই হয়েছে। শেষ মুহুর্তে কাছে না গেলে হয়তো কথা গুলো শুনতে পেতাম না। কেউ কারো জন্য অপেক্ষা করে থাকেনা। আর সব চাইতে বড় কথা, ও তো আমাকে চিনতেও পারেনি। নাহ, ভালই হয়েছে।

বৃষ্টি প্রায় চলে গেছে। গুড়ি গুড়ি যেটুকু হচ্ছে সেটাকে বৃষ্টির প্রহসন বলাই ভাল হবে। শেষ বিকেলের আলোয় চারদিক ঝলমল করছে। পুব আকাশে সুন্দর একটা রংধনুও উঠেছে। ফরহাদের হৃদয়ে আচড় পরাতে প্রকৃতিও যেন খুশি হয়েছে।
শপিংমল থেকে বেড়িয়ে ফরহাদ সিগারেট ধরায়। কষ্টগুলো ধোয়ার সাথে উড়িয়ে দিতে চায় যেন।
হঠাত মেয়েলি কন্ঠের ডাকে ফরহাদ বাস্তবে ফিরে আসে। পেছনে ফিরে তাকাতে ফরহাদের আঙ্গুলের ফাক গলে আপনিতেই সিগারেট পরে যায়। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেনা ফরহাদ।
এক দৃষ্টিতে ফরহাদের দিকে তাকিয়ে আছে কেয়া। চোখে কিছুটা অভিমান। অনেক্ষন পর কেয়াই প্রথমে মুখ খোলে।
– এতক্ষন পিছনে পিছনে ঘুরলে আর একটি বারো কি সামনে এসে নিজের পরিচয়টা দিতে পারলেনা? আর আমিতো ভেবে ভেবে হয়রান হচ্ছি! কে এই ছেলেটা। খুব চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু চিনতে পারছিনা। চোখে চশমা লাগিয়েছো, এত বড় বড় চুল! কিভাবে চিনবো বল?
– ওরে বাবা! এক সাথে এত প্রশ্নের উত্তর কিভাবে দিব!
– উত্তর দিতে হবেনা। আগে বল, আমাকে চিনতে পেরেই কি পিছু নিয়েছিলে নাকি সুন্দরী মেয়ে দেখলে এমন পিছন পিছন ঘুরতে থাক?
শব্দ করে হেসে উঠে ফরহাদ।
– হা হা হা। তুমি একটুও বদলাও নি। কত বছর পর দেখা হলো আর তুমি ঝগরা শুরু করে দিয়েছ! আর পিছনে ঘুরার মত জীবনে আমি একজনকেই পেয়েছি।
– আচ্ছা, তোমার হাতের কাটা দাগটা কি একন আছে?
– তোমার এখনো মনে আছে! হুম আছেতো।
এই বলে ফরহাদ হাত বাড়িয়ে দেয়। অনেক বছর আগে নিজেরই একে দেয়া চিহ্নটাতে কেয়া হাত বুলিয়ে দেখে। দুজনই হেসে উঠে একসাথে। তারপর…………

কথা বলতে বলতে ওরা দুজন হাটতে থাকে। তাদের সঙ্গি হয় বর্ষার গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি আর শেষ বিকেলের আলো।

লিখছেনঃ একজন নিশাচর

Related posts

Leave a Comment